বাঙালি জাতিকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখালেন তিনি। বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে তিনিই খুঁজে বের করলেন রসায়ন শাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। তিনি প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
আপনি ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ এর ওষুধের নাম জানেন? এ কালের অনেকেই হয়তো বলবেন, ওসব বেঙ্গল-ফেঙ্গল এখন চলে না। মডার্ন মেডিসিনের যুগ। 'ভারতীয় রাসায়নিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রথম ভারতীয় স্থপয়িতা', 'বেঙ্গল কেমিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড' ও তার প্রতিষ্ঠাতা রসায়নবিদ ও বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নাম হয়তো এখন খুব কম সংখ্যক ব্যক্তিই জানেন।
স্বাদেশিকতা বোধ তো দূর অস্ত। আশ্চর্যের বিষয় হল প্রফুল্ল রায়ের জন্মদিনটা ২ আগষ্ট কি না কনফার্ম হবার জন্য তিনটে বাংলা ক্যালেন্ডার ও দুটো ইংরেজি ক্যালেন্ডার দেখতে গিয়ে অবাক হলাম কোথাও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের জন্মদিনের উল্লেখ না দেখে। অথচ কত বাবা, ক্ষ্যাপা প্রমুখের জন্মদিন, ছটপুজো, কৌমুদী পুর্নিমা এ সবেরই উল্লেখ আছে। নেই শুধু স্যার পি সি রায়ের নাম।
বাঙালির এই অধঃপতিত অবস্থার কথা শতবর্ষাধিক আগেই লিখে গেছেন তাঁর 'অন্ন সমস্যা ও বাঙ্গালীর নিশ্চেষ্টতা' প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক ১৮৬১ সালে জন্মেও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বাঙালির মনন থেকে মুছে গেছেন। অথচ তিনি বার বার 'ডিগ্রিপ্রিয়,চাকরি প্রিয় বাঙালিকে' 'বিলাসের আরামশয্যা' থেকে জাগাবার চেস্টা করে গেছেন, তাদের দোষ ত্রুটি শুধরে নিতে পথনির্দেশ করেছেন। বাঙালি 'আলস্যের নিদ্রায় সুখের স্বপ্ন দেখে', 'বুদ্ধির অহংকারে অন্ধ হইয়া' জীবন সংগ্রামে ফাঁকি দেয়। ফলে 'বাঙালি সকল দিকের সকল ক্ষেত্র হইতে পরাজিত হইয়া পশ্চাদপদ হইতেছে'।
তিনি কেবল একজন অসামান্য বিজ্ঞানী ছিলেন না, তিনি একাধারে একজন শিক্ষক, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ ও কবিও ছিলেন। শুধুই নীরস বিজ্ঞানশিক্ষা নয়, বরং সমগ্র বাঙালি জাতিকে অন্তর থেকে বিজ্ঞানমনস্ক তথা বিজ্ঞানচেতনা সম্পন্ন করে তোলাই ছিল প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আজীবনের সাধনা। বই থেকে পড়া বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের পরিবর্তে ব্যবহারিক এবং ফলিত বিজ্ঞানের প্রসারে, মাতৃভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রকল্পে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ব্যবসা-বিমুখ বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাসে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ‘বেঙ্গল কেমিক্যালস’ প্রতিষ্ঠা বাঙালিকে স্বাবলম্বী হতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
হরিশ্চন্দ্র রায়। ভদ্রলোকের জমিদারি তখন পড়তির দিকে। বাড়িতে পাওনাদারদের নিয়মিত কড়া নাড়া। স্ত্রী ভুবনমোহিনীদেবী অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে নিজের গয়নার টাকায় কেনা জমিদারির তালুক বিক্রির কাগজে সই করছেন। তাঁদের কলকাতার বাসা উঠে গেল। ফিরলেন খুলনার গাঁয়ে। ছেলেরা উঠলেন হস্টেলে। সেজো ছেলের জীবনে এই দৃশ্যটি মনে থেকে গেল। কিছু দিন পরে সেই ছেলেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতের পথে রওনা দিতে উদ্যোগী হলেন। যাওয়ার আগে মা’কে বললেন, ‘জীবনে সাফল্য লাভ করলে, প্রথমেই সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও বাড়ির সংস্কার করব।’
সে কাজ বেশ কিছুটা করেওছিলেন। কিন্তু বাড়ির তুলনায় বাইরের জগৎ তাঁকে যে বেশি টানে। সেই টান আর দেশের কাজের জন্যই তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় ‘আচার্য’। তিনিই প্রফুল্লচন্দ্র রায়।
তাঁর বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম বিশ্লেষণের ধৃষ্টতা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়। শুধু একটি বিষয়ই বলা যেতে পারে, তা হল - মারকিউরাস নাইট্রাইটের আবিষ্কারকে প্রফুল্লচন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব হিসেবে ধরা হলেও যৌগটির ‘অস্তিত্ব’ এখনও অধরা, দাবি বিজ্ঞানীদের একাংশের। বরং তাঁর বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব, ‘জৈব নাইট্রাইট, গন্ধকযুক্ত বিবিধ জৈব যৌগ এবং ধাতব লবণের সঙ্গে তাদের বিক্রিয়া, জৈব হ্যালোজেন যৌগ বিশেষত ফ্লোরিনযুক্ত এবং পারদের ধাতু যুক্ত জৈব যৌগ - এ সবের প্রস্তুতি ও পরীক্ষণের সূচনা’ করা। কিন্তু এ বিষয়গুলি বহুল চর্চিত। তাই জীবনভর নানা কাজ, জেদের মধ্য দিয়ে কী ভাবে প্রফুল্ল-চরিত্র তৈরি হয়েছিল, তা সন্ধানেরই চেষ্টা করব আমরা।
রসায়নের ক্লাস। ছাত্রদের সামনে এক টুকরো হাড় হাতে নিয়ে বুনসেন বার্নারে পুড়িয়ে মুখে পুরে দিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ছাত্রদের শেখালেন, এটা ক্যালসিয়াম ফসফেট। এছাড়া আর কিছুই নয়। সেটা কোন প্রাণীর হাড় তা-ও আর চেনার উপায় রইল না।
রসায়ন দিয়ে শুধু রসায়ন শিক্ষাই নয়, ছাত্রদের মনে ধর্মান্ধতার মূল উপড়ে ফেলার মন্ত্রটিও প্রবেশ করিয়ে দিতেন তিনি। যত টুকু দরকার, তার বাইরে কতটুকুই বা পড়ার আগ্রহ আছে আমাদের বইবিমুখ আগামীর? অথচ, বই পড়ার আগ্রহ থেকেই জন্ম হয়েছিল এই বাঙালি মনীষীর। নিজের সফলতাকে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন সার্থকতার শিখরে।
১৮৬১, ২ অগস্ট অবিভক্ত বাংলাদেশের রাড়ুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রফুল্লচন্দ্র। প্রপিতামহ মানিকলাল রায় ছিলেন নদিয়া (কৃষ্ণনগরের) ও যশোরের কালেক্টরের দেওয়ান। পিতামহ আনন্দলাল রায় ছিলেন যশোরের সেরেস্তাদার। পিতা হরিশচন্দ্র রায় ও মাতা ভুবনমোহিনী দেবী। বাবা মায়ের আদরের সেই ছোট্ট ফুলু পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন ‘মাস্টার অফ নাইট্রাইটস’ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। কেমন ছিল তাঁর এই জীবন পথ?
নিজ গ্রামে পিতার প্রতিষ্ঠিত স্কুলেই তাঁর শিক্ষার সূচনা। পিতা পুত্রের সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। বই পড়া অপেক্ষা পিতার সঙ্গে কথা বলে অনেক বিষয় বেশি করে শিখতেন। ১৮৪৬ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণনগর কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ, ক্যাপ্টেন ডি এল রিচার্ডসনের লেখা ‘ব্রিটিশ কবিগণের জীবনী’ বইটি তিনি পান তাঁর পিতার কাছ থেকে। এটাই ছিল তাঁর অমূল্য পৈতৃক সম্পদ।
১৮৭০ সালে সপরিবার চলে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন হেয়ার স্কুলে। রাত জেগে পড়াশোনা করার ফলে হজমের সমস্যা ও রক্ত আমাশয় হলে তিনি ফিরে আসেন নিজের গ্রামে। এই অসুস্থতাই ছিল তাঁর জীবনে ছদ্মবেশী-আশীর্বাদ। কারণ গ্রামে এসে তিনি অনেকখানি সময় কাটাতেন পিতার তৈরি লাইব্রেরিতে। বাঁধাধরা বইয়ের বাইরে, শেক্সপিয়ার, এমার্সন, কার্লাইল, ডিকেন্সের রচনা, নিউটন, গ্যালিলিও, ফ্রাঙ্কলিনের জীবনী, বাংলা সাহিত্য, ইতিহাস ইত্যাদি ইচ্ছেখুশি বই পড়ার আনন্দে মেতে উঠলেন তিনি। স্যর উইলিয়াম জোন্সের প্রশ্নের উত্তরে জোন্সের মায়ের উক্তি ‘পড়িলেই সব জানিতে পারিবে’ কথাটি প্রফুল্লচন্দ্রের মনে গভীর ভাবে রেখাপাত করে।
সুস্থ হয়ে ১৮৭৩ সালে ফিরে আসেন কলকাতায়। ভর্তি হন অ্যালবার্ট স্কুলে। এরপর এন্ট্রান্স পাশ করে ভর্তি হন মেট্রোপলিটনে। কারণ বিদ্যাসাগরের এই কলেজটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ায় সেটি তাঁর ‘নিজের’ বলে মনে হত। ভারতে প্রথম এই প্রতিষ্ঠানটিই উচ্চশিক্ষাকে মাধ্যমিক শিক্ষার মতো সুলভ করার সাহসী প্রচেষ্টা দেখায়। এফএ পড়ার সময় থেকেই প্রেসিডেন্সি কলেজে 'বাইরের ছাত্র' হিসেবে অধ্যাপকদের রসায়ন বিষয়ে বক্তৃতা শুনতেন। নিজের অজ্ঞাতসারেই তিনি রসায়নের প্রতি আকৃষ্ট হন। ইংরাজি সাহিত্যানুরাগী প্রফুল্লচন্দ্র বিজ্ঞানের আনুগত্য স্বীকার করে নেন। রসায়ন নিয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সিতে। এখানে তিনি বিখ্যাত প্রফেসর আলেকজান্ডার পেডলারের সান্নিধ্যে অনুপ্রাণিত হয়ে নিজ গৃহেই ছোট্ট গবেষণাগার গড়ে গবেষণা শুরু করেন। নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটির 'গিলক্রাইস্ট বৃত্তি' পরীক্ষা দেন এবং উত্তীর্ণ হন। ১৮৮২ সালে ইংল্যান্ড যাত্রা করেন।
এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি থেকে ১৮৮৪ সালে বি. এস. সি. ডিগ্রি পান। এখানে 'ইন্ডিয়ান বিফোর অ্যান্ড আফটার দ্য মিউটিনি’ বিষয়ে এক প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। সত্যের সাধক ছিলেন বলেই ভারতে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনের কুপ্রভাব সাহসিকতার সঙ্গে তুলে ধরতে পেরেছিলেন তাঁর সেই লেখায়। তাঁর ব্রিটিশ বিরোধী প্রবন্ধটি পুরস্কৃত না হলেও প্রশংসিত হয়েছিল। এডিনবার্গ থেকেই ১৮৮৭ সালে ডি. এস. সি. ডিগ্রির সঙ্গে সঙ্গে ‘হোপ প্রাইজ’ বৃত্তি লাভ করেন। ১৮৮৮-তে তিনি ফিরে এলেন কলকাতায়।
দেশে ফিরে কার্যত ১১ মাস কর্মহীন ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র! এই পর্বে বিশেষ ভাবে তাঁর পাশে দাঁড়ালেন জগদীশচন্দ্র বসু ও বন্ধুরা। শেষমেশ ১৮৮৯-র মাঝামাঝি প্রেসিডেন্সি কলেজে আড়াইশো টাকা বেতনের ‘সহকারী অধ্যাপক’-এর কাজ জুটল প্রফুল্লচন্দ্রের। তত দিনে তাঁর যোগ্যতার প্রতি সরকার অবিচার করেছে, ক্রফট সাহেবের কাছে সে কথা বলতে অপমানও হজম করতে হল তাঁকে। ক্রফট উদ্ধত ভাবে তাঁকে বললেন, ‘আপনার জন্য জীবনে অনেক পথ খোলা আছে। কেউ আপনাকে এই পদ গ্রহণ করতে বাধ্য করছে না!’ পাশাপাশি, বাংলার শাসনকর্তা চার্লস ইলিয়ট ‘ইম্পিরিয়াল সার্ভিসে’ ভারতীয়দের নিয়োগের পথ রুদ্ধ করে দিলেন।
প্রেসিডেন্সিতে বিখ্যাত অধ্যাপক স্যার আলেকজাণ্ডার পেডলারের সান্নিধ্যে নিজের ঘরেই একটি ছোটোখাটো গবেষণাগার বানিয়ে ফেলেছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র, সেখানেই চলতে থাকে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নিরলস জ্ঞানচর্চা। প্রেসিডেন্সির গবেষণাগারটি হয়ে উঠল প্রফুল্লচন্দ্রের আত্মার সঙ্গী। ভারতীয় নানা খাদ্যদ্রব্য ও তার ভেজাল নিয়ে এই পর্বেই গুরুত্বপূর্ণ বিশ্লেষণটি করলেন তিনি।
পাশাপাশি, তাঁর অধ্যাপক-সত্তাও ক্রমে বিকশিত হতে শুরু করল। ১৯০৯ সাল ভারতের রসায়ন তথা বৈজ্ঞানিক গবেষণার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বছর। জ্ঞানেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মানিকলাল দে, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, পুলিনবিহারী সরকার, নীলরতন ধর, মেঘনাদ সাহা, রসিকলাল দত্ত-সহ একঝাঁক কৃতী ছাত্র পেল প্রেসিডেন্সি। ছাত্রেরা পেলেন প্রফুল্লচন্দ্রকে। এঁদের অনেককে নিয়েই প্রফুল্লচন্দ্রের প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে পরবর্তী সময়ে তৈরি হবে ‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব কেমিস্ট্রি’
তিনি। তাঁর সুন্দর বাচনভঙ্গি ও রসবোধ দিয়ে বাংলা ভাষায় বক্তৃতার মাধ্যমে রসায়নের পাঠ ছাত্রদের কাছে সহজবোধ্য ও মনোগ্রাহী করে তুলতেন। বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের সফলতার জীবন কাহিনি গল্পের ছলে তুলে ধরতেন ছাত্রদের কাছে। অল্প সময়েই শিক্ষক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষকতার পাশাপাশি চলতে থাকে তাঁর গবেষণা।
আসলে ছাত্র-রত্নদের চিনতে পারাটাই মাস্টারমশাইয়ের আসল কৃতিত্ব। এ প্রসঙ্গে জিতেন্দ্রনাথ রক্ষিতের কথা বলতে হয়। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারেননি। কিন্তু ‘ব্যবহারিক রসায়ন’-এ তাঁর অসাধারণ দক্ষতা। জাতীয় শিক্ষা পরিষদের পরীক্ষাগারে কিছু দিন কাজ করেই তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দিলেন। প্রফুল্লচন্দ্র তাঁকে নিজের গবেষণা কাজে সহায়তার জন্যও ডেকে নিলেন। কালক্রমে, জিতেন্দ্রনাথ সরকারি আফিম বিভাগে বিশ্লেষকের চাকরি পান।
প্রেসিডেন্সির পরে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধে ১৯১৬-এ সায়েন্স কলেজে যোগ দিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। আইনজীবী তারকনাথ পালিত ও রাসবিহারী ঘোষের দানে তৈরি এই কলেজ। কিন্তু সরকার এই কলেজ থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকল। দ্বিধাহীন ভাবে বিলেতের মাটিতে দাঁড়িয়েই প্রফুল্লচন্দ্র বললেন, তাঁরা কলেজের জন্য অনুদান চাইলেই সরকার বলে ‘অর্থাভাব’। উল্টো দিকে, দেশের ধনী ব্যক্তিদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি সম্পর্কে মুখ ফিরিয়ে থাকারও সমালোচনা করলেন।
অথচ নিজে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দশ হাজার টাকা দান, মাদ্রাজ, নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে গিয়ে প্রাপ্য অর্থ সেখানেই দিয়ে আসা, কলকাতার সিটি কলেজ, এমনকি গ্রামে তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত স্কুলটির পাশে দাঁড়ানো - এমন নানা কাজ আজীবন করেছেন প্রফুল্লচন্দ্র।
আসলে শিক্ষার জগতে প্রফুল্লচন্দ্র একটি ‘লেগাসি’। বিষয়টি তাঁর ছাত্র নয়, বরং তাঁর ‘ছাত্রের ছাত্র’র মুখে শোনা যাক। এই ছাত্রটি বলছেন, ‘আমি একটা গুরুতর অপরাধ করেছি যে, স্যার পি সি রায়ের ছাত্র হতে পারিনি। সে জন্য হয়তো তিনি আমাকে ক্ষমা করেননি।...আমি তাঁর রাসায়নিক ‘প্রশিষ্য’ হয়েছি। পি সি রায়ের ছাত্র অতুলচন্দ্র ঘোষের কাছে আমি রসায়ন শিখেছি।’ বক্তব্যটি, ভারতের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পুরস্কার যাঁর নামে, সেই শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের!
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে নিয়ে বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস তাঁর 'প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানে অগ্রগতি' প্রবন্ধে লিখেছেন :-
"আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিদেশে রসায়নে কৃতবিদ্য হয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে দেশে ফিরে এলেন। এদিকে যেমন ভাবছেন কি ভাবে দেশে রাসায়নিক শিল্পের পুনরুজ্জীবন করা যায় অন্যদিকে অন্বেষণ শুরু করলেন প্রাচীন কালের পুঁথিতে রসায়নের উল্লেখের।
আচার্য রায় নিজের অধ্যাপনা আর গবেষণার কাজের বাইরের সময়টায় বিভিন্ন প্রাচীন পুঁথিপত্র ঘেঁটে তার থেকে বিভিন্ন তথ্য আবিস্কার করতেন। তিনি জেনেছিলেন যে পুরাকাল থেকেই ভারতবর্ষীয়রা ক্ষার (Alkali) ও অম্লকের (Acid) প্রস্তুত প্রণালী আবিস্কার করেছিলেন। লোহা‚ শিসা‚ তামা‚ টিন‚ পারদ ইত্যাদি ধাতুদের বিশেষ অবস্থায় আনতে পারতেন। নানা শোধনক্রিয়া তাঁরা অনুসরণ করতেন। ধাতুভস্ম প্রস্তুত করার অনেক উন্নত প্রণালী তাঁদের জানা ছিল। রাসায়নিক নানা প্রক্রিয়ার জন্য তাঁরা নানা যন্ত্রের উদ্ভাবন করেছিলেন। পুঁথির অনেকগুলিতে পারদের নানা রূপান্তর বর্ণনা পান তিনি। গন্ধকের সাথে নানা ধাতুর যৌগিক পদার্থ অনেকগুলি ভারতবর্ষীয়দের আবিষ্কার বলে জেনেছিলেন আচার্য। বহু বছর পরিশ্রম করে ভারতবাসীদের বিজ্ঞানচর্চার এক নতুন অধ্যায়ের খবর দিয়ে বিশ্বের পণ্ডিত মহলে এক বরেণ্য স্থান অধিকার করলেন আচার্য রায়।
এ দেশ থেকে গণিতের অনেক আবিস্কার যে আরবজাতির মাধ্যমে পাশ্চাত্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তা কোলব্রুক সাহেব আগেই দেখিয়েছিলেন। কোলব্রুক সাহেব এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে খৃস্টাব্দ পঞ্চম শতাব্দীর আশেপাশে আর্যভট্ট বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। আর্যভট্ট নাকি শিক্ষা দিতেন যে পৃথিবী দৈনিক তার অক্ষের চারদিকে ঘুরছে। তিনি সূর্য ও চন্দ্রগ্রহণের কারণ সঠিক বার করে নাকি বলেছিলেন‚ চন্দ্র কি গ্রহরা কেউই নিজে আলোক বিকিরণ করে না। তাদের উদ্ভাসিত করে সূর্যের আলো। আর্যভট্টের বইয়ে নাকি পৃথিবীর ব্যাস ১০৫০ যোজন ও তার থেকে পরিধি ও ব্যাসের অনুপাত ২২/৭ (pi) ধরে পৃথিবীর পরিধি ৩৩০০ যোজন দাঁড়ায়। এই নির্ধারণ সত্য পরিমাপের খুব কাছাকাছি - যোজনকে চার ক্রোশের সমান ধরলে আর এক ক্রোশের মান ১.৯ মাইল ধরলে পৃথিবীর পরিধি দাঁড়াবে ২৫০৮০ মাইল যা বাস্তবের মাপের (24901 Miles) খুব কাছাকাছি। কোলব্রুক সাহেব আরও দেখিয়েছেন যে ভারতবর্ষীয়রা গণিতশাস্ত্রে Surd-এর ব্যবহার জানতেন। ঋণাত্মক সংখ্যার (Negetive Number) ব্যবহার করতেন তাঁদের বিশ্লেষণে। দ্বিঘাত সমীকরণ (Quadratic Equation) বা আরো জটিল সমীকরণের সমাধান তাঁরা জানতেন।
আচার্য রায় সেই একই ব্যাপার দেখালেন রসায়নের ব্যাপারে। চরক ও সুশ্রুতের অনুবাদের সঙ্গে রাসায়নিক অনেক ভারতীয় প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল।
মহেঞ্জোদাড়োর উৎখননের থেকে আমরা জেনেছি এ দেশেই প্রথম নানা রঙের কাচ প্রস্তুত হত। ব্রোঞ্জ আর কাঁসার ধাতুর নানান উপকরণ আমরা পেয়েছি। এ দেশেই যে বিশুদ্ধ লোহা প্রস্তুত ও রপ্তানি হত সেই খবর আমরা পেয়েছি। ইস্পাত তৈরির রহস্যও ভারতের আবিস্কার। বিখ্যাত দামাস্কাস আর টলেডোর তরবারি নির্মাণে ভারতীয় ইস্পাতই ব্যবহার হত।"
এক দিন হঠাৎই তিনি আবিষ্কার করলেন রসায়নের এক অতি বিষম বস্তু' মারকিউরাস নাইট্রাইট'। রসায়নের ইতিহাসে এক চরম আশ্চর্যজনক এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল এই আবিষ্কার। পারদের সংস্পর্শে লঘু নাইট্রিক অ্যাসিড রাখলে এই অস্থায়ী যৌগ উৎপন্ন হয়। প্রায় সমস্ত ধাতুরই নাইট্রাইট যৌগ আবিষ্কার করা সেসময় সম্ভব হলেও অত্যন্ত ভঙ্গুর ও অস্থায়ী এই বিশেষ যৌগটি কেউই তৈরি করতে পারেননি। এই গবেষণাপত্রটি প্রথম প্রকাশ পায় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল’-এর জার্নালে এবং একইসঙ্গে ১৮৯৬ সালের ২৮ মে লণ্ডনের ‘নেচার’ পত্রিকায়। এছাড়াও সালফাইডস ও হাইপোনাইট্রাইট বিষয়েও প্রচুর গবেষণা করেছেন তিনি। প্রফুল্লচন্দ্র সমগ্র জীবনে মোট ১২টি যৌগিক লবণ ও ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন। প্ল্যাটিনাম, ইরিডিয়াম ইত্যাদি ধাতুর বিষয়েও তাঁর গবেষণাপত্র রয়েছে। ১৮৮৭ সালে তাঁর ডি. এস. সি. ডিগ্রির গবেষণাপত্রটি জমা দেন তিনি যার বিষয় ছিল ‘অন পিরিয়ডিক ক্ল্যাসিফিকেশন অফ এলিমেন্টস্’ (On Periodic Classification of Elements)। এছাড়া তাঁর অন্যান্য গবেষণাপত্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - ‘অন অ্যানালিসিস অফ ডাবল সালফেট্স অ্যাণ্ড দেয়ার ক্রিস্টালস্’ এবং ‘হাইপোনাইট্রাইটস অফ মার্কারি’। এগুলি ছাড়াও প্রফুল্লচন্দ্র সিলভার নাইট্রাইট থেকে অ্যামোনিয়াম নাইট্রাইট কিংবা মারক্যাপ্টাইল মূলকও আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁর মোট গবেষণাপত্রের সংখ্যা ১০৭টি।
ইউরোপীয় বিজ্ঞানীগণ তাঁকে 'মাস্টার অব নাইট্রাইটস' আখ্যায় ভূষিত করেন। পরনে ধুতি, কালো কোট, চুল অবিন্যস্ত, তাঁর এমন উদাসীন বেশভূষায় আবৃত ছিল এক দূরদর্শী কর্মচঞ্চল প্রাণ। তিনি বুঝেছিলেন, ‘‘একটা সমগ্র জাতি শুধুমাত্র কেরানী বা মসীজীবী’’ হয়ে টিকে থাকতে পারে না। বাঙালি জাতিকে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ দেখালেন তিনি। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন 'বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকল ওয়ার্কস'। মূলধন বলতে ছিল, মাত্র আটশো টাকা আর পূর্ণ আত্মবিশ্বাস। ৯১ নম্বর, আপার সার্কুলার রোডে আচার্যের ভাড়াবাড়িটিই এই শিল্প প্রতিষ্ঠানটির আঁতুড়ঘর। এর নেপথ্যে ছিল বিদেশ থেকে নানা দ্রব্যের আমদানিতে লাগাম পরানো এবং বাঙালি তথা ভারতীয়কে কেরানি থেকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর ইচ্ছে।
এ ছাড়াও ক্যালকাটা পটারি ওয়ার্কস, বেঙ্গল এনামেল ওয়ার্কস, ন্যাশনাল ট্যানারি ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠায় তিনিই ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। এডিনবার্গে থাকাকালীন সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল সোসাইটির সদস্য রূপে বিভিন্ন রাসায়নিক কারখানা পরিদর্শন করে রাসায়নিক কারখানা তৈরির প্রাথমিক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তিনি। বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে তিনিই খুঁজে বের করলেন রসায়ন শাস্ত্রে প্রাচীন ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। ধাতু সঙ্কর তৈরিতে ভারত যে পিছিয়ে ছিল না, চরক সংহিতা-সুশ্রুত সংহিতায় উল্লেখিত অস্ত্রোপচারের সূক্ষ্মাগ্র যন্ত্র যেমন স্ক্যালপোল বা ল্যানসেট তার প্রমাণ। ইস্পাত আবিস্কারের প্রথম কৃতিত্বও প্রাচীন ভারতের। প্রাচীন রসায়নে শুধু ইজিপ্ট, সিরিয়া, চিন বা আরব নয় প্রাচীন ভাতরবর্ষও যে কতটা এগিয়ে ছিল,তা তুলে ধরতেই তিনি লিখলেন ‘দ্য হিস্ট্রি অব হিন্দু কেমিস্ট্রি’। এ বিষয়ে প্যারিসের বিখ্যাত বিজ্ঞানী মার্সিলিন বের্তেলোর সান্নিধ্য তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। এই কাজের জন্য সংস্কৃত ও পালি ভাষা শিখেছিলেন।
প্রফুল্লচন্দ্রের বিজ্ঞান ভাবনা যা-ই হোক না কেন, তাঁর সব কিছু জুড়ে ছিল দেশ আর দেশের প্রকৃতি। তাই ১৮৯০-এ তৈরি করেন ‘নেচার ক্লাব’। নীলরতন সরকার, প্রাণকৃষ্ণ আচার্য, রামব্রহ্ম সান্যাল, হেরম্বচন্দ্র মৈত্র, বিপিনবিহারী সরকার ছিলেন এর সদস্য। পাশাপাশি, ‘কলকাতার ফুসফুস’ ময়দানে ঘুরতে যাওয়া, তা-ও করেছেন সমান ভাবে।
আসলে প্রকৃতির উপরে মানুষের কেরদানিটা সহ্য হয়নি প্রফুল্লচন্দ্রের। তাই রবীন্দ্র সরোবরে ছট করতে চাওয়া, জলাভূমি বুজিয়ে ইমারত তৈরি করার বর্তমান দেশে প্রফুল্লচন্দ্রের একটা কথা বিশেষ ভাবে মনে করা যায় - ‘‘পশ্চিমবঙ্গে পুকুর বাঁধ প্রভৃতি জলসেচ প্রণালীর ধ্বংসের সহিত তাহার পল্লীধ্বংসের কাহিনী ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।’’ এই জন-বিজ্ঞানকে বোঝাতে বাংলা ভাষায় সাধারণের উপযোগী বইও লিখেছেন প্রফুল্লচন্দ্র। আদতে তিনি চেয়েছিলেন স্থিতিশীল উন্নয়ন।
লেখক হিসেবে প্রফুল্লচন্দ্র সারাজীবনব্যাপী বহু নিবন্ধ-প্রবন্ধ এবং কিশোর-কিশোরীদের উপযোগী ছাত্র-পাঠ্য বইপত্র লিখেছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ‘নব্যরসায়নী বিদ্যা ও তাহার উৎপত্তি’ (১৯০৬), ‘বাঙালীর মস্তিষ্ক ও তাহার অপব্যবহার’ (১৯১০), ‘চা পান ও দেশের সর্বনাশ’ (১৯৩২) ইত্যাদি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে ১৯৩৭ সালে লেখা ‘আত্মচরিত’ এবং সুবিখ্যাত ‘দ্য হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল কেমিস্ট্রি’ (১৯০২ ও ১৯০৯) বই দুটি প্রধান। এই দ্বিতীয় বইটিতেই তিনি প্রমাণ করে দেখান যে ভারতের রসায়নচর্চার ইতিহাস বহু প্রাচীন। সেই চরক-সুশ্রুতের সমকালীন ভারতের রসায়নচর্চার মাহাত্ম্য তিনি এই বইতে প্রমাণ করেন। তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ হল - ‘জাতি গঠনে বাধা - ভিতরের ও বাহিরের’ এবং ‘জাতীয় সম্পদের মূলে বিজ্ঞানের শক্তি’। ১৯০৩-এ প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর বাবার নামে স্থাপন করেন আর. কে. বি. কে হরিশচন্দ্র স্কুল’ এবং ১৯০৯ সালে তাঁর নিজের জন্মভূমিতে তিনি একটি সমবায় ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশে ‘পি. সি. কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন ১৯০৮ সালে।
ব্যতিক্রমী এবং আমরণ উদার মহৎ কার্যের জন্য বাঙালি বিজ্ঞানী হিসেবে প্রফুল্লচন্দ্র ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘নাইটহুড’ উপাধি পান। তার আগে ১৯১১-তে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯১৯-এ মহীশূর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘ডক্টরেট’ সম্মান জ্ঞাপন করে।
সালটা ১৯২১। বিলেত থেকে ঘুরে খুলনার গ্রামে বেড়াতে এলেন এক অধ্যাপক। কলকাতায় নামী কলেজে পড়াতেন তিনি। সারা ভারতে তাঁর নাম। এত বড়ো মানুষ, অথচ মনটা যে মাটির সঙ্গেই জুড়ে আছে। গ্রামে আসবেন না, তা কি হয়! কিন্তু এসে যা দেখলেন, সেটার কথা হয়ত কল্পনাও করেননি ওই অধ্যাপক। নিজের জন্মস্থান, খুলনার দিকে দিকে তখন হাহাকার। লোকজন মরে আছে ঘরে। জল, হাওয়া, খাবার - সবই যেন দূষিত। দুর্ভিক্ষ যেন গোটা জায়গাটিকে শ্মশান করে রেখেছে। তার ওপর ছড়িয়ে পড়েছে ম্যালেরিয়া। কিন্তু খুলনার জেলা প্রশাসন থেকে কিছুই স্বীকার করা হচ্ছে না। এরম অবস্থাতেই এগিয়ে এলেন ওই মহান অধ্যাপক। গঠন করেন রিলিফ কমিটির। জোর কদমে চলতে লাগল কাজ। আগে মানুষ, তার জীবন, তারপরে বাকি সব। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আসল মন্ত্র তো ছিল এটাই।
তখনই তৈরি হল 'বেঙ্গল রিলিফ কমিটি। খুলনার মারাত্মক দুর্ভিক্ষে নেমে পড়েছিল এই দলটি। নেতৃত্বে ছিলেন একজন, প্রফুল্লচন্দ্র রায়। ঋষিতুল্য এই মানুষটির পরিচয় একজন কিংবদন্তি বিজ্ঞানী হিসেবেই থেমে থাকে না। দেশীয় শিল্পেও যেমন দিশা দেখিয়েছিলেন, তেমনই মানুষের বিপদের সময় সমস্ত রকম ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। খুলনা দুর্ভিক্ষই একমাত্র নয়। একইরকম বিপদের মধ্যে পড়ে উত্তরবঙ্গ। তবে সেটার কারণ ছিল অন্য।
খুলনার দুর্ভিক্ষ পেরিয়েছে সবে এক বছর হল। ১৯২২ সালে আবারও একটা আবর্তে পড়ল বাংলা। সেপ্টেম্বরের প্রবল বৃষ্টিপাতে উত্তরবঙ্গের আত্রাই নদী ফুলে ফেঁপে উঠল। অন্যান্য নদীও থেমে থাকল না। দেখা দিল প্রবল বন্যা। ব্রহ্মপুত্রের জল আত্রাই নদী হয়ে ভাসিয়ে দিল সব জায়গা। কিন্তু কলকাতায় এই খবর একটু দেরিতেই পৌঁছয়। কারণটি সহজেই অনুমেয়। তখনকার দিনে এত আধুনিক আয়োজন ছিল না। তার ওপর যে মেল ট্রেন দার্জিলিং থেকে ছেড়েছিল, তা পার্বতীপুরে এসে থেমে আছে। আগে লাইন ভেঙে গেছে। এখন উপায়? কোনোমতে সেখানকার রেল কর্মীদের বুদ্ধিতে একটি রাস্তা খুঁজে পেয়ে তাঁরা চলে আসেন কলকাতা। তখন প্রথম খবরে ছাপল এই ভয়ংকর দুর্যোগের কথা।
ভারত সভা হলে আয়োজিত হল জনসভা। তৈরি হল বন্যা সাহায্য কমিটি। কাজে নামল বেঙ্গল রিলিফ কমিটিও। প্রফুল্লচন্দ্র এবার আর দায়িত্ব নিতে চাইছিলেন না। পরোক্ষে থেকে সমস্ত নজরে রাখবেন, এমনই ঠিক ছিল। কিন্তু সেটা হল না। কমিটির সভাপতি’র আসনে বসলেন তিনি। অবশ্য এবার তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও একজন। এই ব্যক্তিটি জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত। বয়সে তরুণ, কিন্তু অদ্ভুত তেজ আছে। তিনি এবার মাঠে নামলেন সবার সঙ্গে। যুবকটির নাম? সুভাষচন্দ্র বসু!
বিজ্ঞান কলেজে বন্যা সমিতির অফিস তৈরি করা হল। স্বেচ্ছাসেবক, সাধারণ মানুষ, ছাত্র, শিক্ষক - সবার উপস্থিতিতে ভরে উঠল প্রাঙ্গণ। সব জায়গায় সাহায্যের জন্য আবেদন করা হল। দেশের মানুষের কাছে তো বটেই, বিদেশেও। সুভাষচন্দ্র বসু নিজে চলে গেলেন উত্তরবঙ্গে। সংবাদের ভিত্তিতে নয়, সরেজমিনে নিজের চোখে দেখতে চান ব্যাপারটা। সেখানেও সমিতি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময়ই উঠে এল ক্ষতির পরিমাণের প্রসঙ্গও। সবাই বুঝতে পারলেন, সরকার থেকে যে অঙ্কটা দেওয়া হচ্ছে, সেটা আসলে কিছুই না। আসল পরিস্থিতি তার থেকেও গুরুতর। একে তো রেললাইন, চাষের জমি সমস্ত ডুবে যায়। তৎকালীন স্টেটসম্যান পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবর অনুযায়ী, শুধু বগুড়া জেলায় ক্ষতির পরিমাণ এক কোটির ওপরে! তালোরা গ্রামে যে ২০০টি বাড়ি ছিল, তার ৭টি মাত্র অবশিষ্ট আছে। পাবনা আর রাজশাহী জেলার মিলিত ক্ষতির পরিমাণ পাঁচ কোটির ওপর। সব মিলিয়ে সংখ্যাটি কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেটা ভেবেই আতঙ্ক আসে আজ!
সুভাষচন্দ্র বসুর পর ডাঃ ইন্দ্রনারায়ণ বসুও এই কাজে এসেছিলেন। নিজে থেকেই অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এটা তো আসলে মানুষকে, দেশকে বাঁচানোর লড়াই। ঠিক যে কাজটি এক বছর আগে খুলনাতে করেছেন সবাই। সুভাষচন্দ্র বসুও সমস্তটা দিয়ে লড়েছিলেন এই সময়। পরে এই বন্যার সমস্যার জন্য সরকারকেও দায়ী করেন অনেকে। অভিযোগ, উত্তরের ছোটো রেললাইনকে বড়ো করার ফলে নিকাশি ব্যবস্থায় আঘাত পড়ে। সেইজন্য আগেও বন্যা হয়েছিল বেশ কয়েকবার। সেখানকার কর্মীরা সরকারকে বলেও; কিন্তু ব্রিটিশ প্রশাসন তাতে বিন্দুমাত্র সাড়া দেননি। আর সেই সময়, বন্যা বা দুর্ভিক্ষ হলে, রোগের প্রাদুর্ভাবও বেড়ে যেত। ভয় ছিল সেটারও। অথচ সরকার তথ্য চাপছে। আগেও ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু সেসব দূরে রেখে, রিলিফ কমিটি ও বন্যা সাহায্য কমিটি যে তৎপরতা দেখিয়েছিল, তা এক কথায় ছিল অভূতপূর্ব। আর এই সবকিছুর মূলে ছিলেন একজন মানুষ - আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। আজকের এমন অবস্থাতেও তিনি নিশ্চয়ই থেমে থাকতেন না!
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম। তিনি বলেন, ‘‘দেয়ার আর অকেশনস্ দ্যাট ডিমানডেড দ্যাট আই সুড লিভ দ্য টেস্ট টিউব টু অ্যাটেন্ড টু দ্য কল অফ দ্য কান্ট্রি। সায়েন্স ক্যান ওয়েট, স্বরাজ কান্ট।’’ তাঁর অর্জিত আয়ের প্রায় সবটুকুই দেশহিতার্থে দান করে গিয়েছেন। ত্যাগেই ছিল তাঁর তৃপ্তির আনন্দ। ১৯২২ সালে রসায়নে বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাঁর দানের টাকা থেকে চালু করেন ‘নাগার্জুন পুরস্কার’।
১৯৪৪, ১৬ জুন। শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন অকৃতদার বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী। কিন্তু তাঁর প্রয়াণের পরে, এমনকি তাঁর জীবিত অবস্থাতেও বাঙালি, ভারতীয়রা কতটা রক্ষা করতে পেরেছে প্রফুল্ল-ঐতিহ্য? জীবিত অবস্থায় তাঁর শেষ জন্মদিন পালিত হয় মেঘনাদ সাহার উদ্যোগে। কিন্তু এ জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি সমস্যায় পড়েছিলেন। আর প্রফুল্লচন্দ্রের মৃত্যুর পরে সমসময়ে তাঁর সাধের শিল্প প্রতিষ্ঠানটি নিয়েও নানা প্রশ্ন সামনে আসে! তাঁকে আমরা কতটা মনে রেখেছি? আমাদের অভ্যস্ত জীবনের চক্রবূহ্যে আত্মতৃপ্তি কোথায়? আত্মকেন্দ্রিক হতে হতে আমরা ক্রমশ আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ছি না তো?
শিল্প স্বনির্ভর ভারত গড়ার লক্ষ্যে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালস অ্যান্ড ফার্মাসিউটিকল আজ বিলগ্নিকরণের পথে। ২০১৬ সালে এই সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্র। জল গড়ায় কোর্টে। সংস্থার আধিকারিক মাইক্রোবায়োলজিস্ট ও কর্মীদের চেষ্টায় বিগত তিন অর্থবর্ষেই লাভের মুখ দেখেছে এই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। গত অর্থবর্ষে এর মুনাফা হয় সর্বাধিক - প্রায় ২৫ কোটি টাকা। সংস্থার পানিহাটির ২৭ একর জমিতে রয়েছে ফিনাইল ও ন্যাপথলিন তৈরির কারখানা। এখানকার অতিরিক্ত ২৫ একর জমিও (যার বর্তমান বাজার মূল্য ৪০০ কোটি টাকা) বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। এছাড়াও মানিকতলার ১৪ একর জমিতে রয়েছে ওষুধ তৈরির কারখানা। কানপুরে ৩ একর ও মুম্বাইতে একটি বাড়ি সহ দেড় একর জমি রয়েছে।
এখানকার বহু পণ্য যেমন ফিনাইল, কালমেঘ, ক্যান্থারাইডিন অয়েল, ন্যাপথালিন, ইথুরিয়া অয়েনমেন্ট, অ্যাকুয়াটাইকোটিস সহ নানা ওষুধ অত্যন্ত জনপ্রিয়। সংস্থাটির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে প্রায় চারশো কর্মীর পরিবার। সেই সঙ্গে জুড়ে আছে জাতীয়তাবাদী বাঙালির গৌরবগাঁথা।
স্বাভাবিক ভাবেই এমন ঐতিহাসিক এবং বর্তমানে লাভে চলা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেঙ্গল কেমিক্যালস বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত সবাইকেই বিস্মিত করেছে। কেন্দ্রের এই বিলগ্নিকরণের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচিত হোক। আগামী দিনে ঋণমুক্ত হয়ে মিনিরত্ন (মহারত্ন, নবরত্ন, মিনিরত্ন ১, মিনিরত্ন ২) ক্যাটাগরির তকমা আদায় করে নিক বেঙ্গল কেমিক্যালস।
প্রফুল্লচন্দ্র বাঙ্গালি জাতকে চিনেছিলেন যথাযথ ভাবেই। তা না হলে লিখতে পারেন অত দিন আগেই এই সাংঘাতিক সত্য কথাটা - “আমাদের জীবনটা যেন দিনগত পাপক্ষয়। শুধু আলস্যের আরাম শয্যায় শয়ন করিয়া আমরা পদে পদে মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা ও অবমাননা করিতেছি। আজ বাঙালির পরাজয় পদে পদে।” যতই কবি লিখে যান - "বিষম ধাতুর মিলন ঘটায়ে বাঙ্গালী দিয়েছে বিয়া।" আজকের বাঙালি প্রজন্মের কাছে তার কোন মূল্যই নেই। এবার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের প্রদর্শিত পথই হোক আমাদের লক্ষ্য। তাঁর জীবনালোকে দূরীভূত হোক আত্মবিস্মৃতির আঁধার।
আজ এই মহান বিজ্ঞানীর ১৬১তম জন্মদিবসে আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
★ তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :- শুভ্রদেব বল, আনন্দবাজার পত্রিকা, 'আত্মচরিত' : প্রফুল্লচন্দ্র রায়, ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র’ : রবীন মজুমদার, ‘অন্বেষা’ (প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিশেষ সংখ্যা), ‘প্রফুল্লচন্দ্র রে’ : জে সেনগুপ্ত, ‘জার্নাল অব দি ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি’, প্রহর, এই সময়, সব বাংলায়, উইকিপিডিয়া।